শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৫:৩৭ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
রমজানে খাদ্য নিরাপত্তা

রমজানে খাদ্য নিরাপত্তা

ড. মো: মিজানুর রহমান:

রমজানের রোজা পালন ইসলামে অবশ্য করণীয় কাজ। রমজান মাস সংযম, ধৈর্য ও অঙ্গীকারের সমার্থক। রমজান আধ্যাত্মিকতার প্রতিফলন, উন্নতি, ভক্তি ও বেশি ইবাদতের মাসই শুধু নয়, বরং এ মাসে মুসলমানদের আত্মশৃঙ্খলা ও সহানুভূতি বৃদ্ধি এবং লোভ ও খারাপ অভ্যাস থেকে নিজেকে দূরে রাখার মাসও। রমজান এমন একটি মাস, কেউ ন্যায়বিচার এবং নিয়ম, সামাজিক ও আইনি বাধ্যবাধকতা মেনে চলার প্রত্যাশাও করে।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বাংলাদেশে রমজানের একটি বিশেষ অবস্থান রয়েছে। মুসলিম জনসংখ্যা শুধু এর ধর্মীয় অনুভূতির জন্যই নয়, বরং এর আর্থসামাজিক কল্যাণেও উন্মুখ থাকে। এ শেষোক্ত প্রত্যাশাই ঈমানদারের হৃদয়ের পূর্ণতা এবং প্রত্যাশাকে প্রভাবিত করে, কারণ রোজার মাসের সাথে সাধারণ মানুষের ভাগ্য জড়িত।

দুর্ভাগ্যবশত, লক্ষণীয়- রমজানের অনন্য বৈশিষ্ট্যজনিত বিভিন্ন সুযোগের অপব্যবহার করে ব্যবসায়ীরা এ মাসে শোষণ করেন ভোক্তাদের। তাদের মুনাফার লোভী তাড়নার কোনো সীমা নেই। তারা অতিরিক্ত মুনাফার জন্য ভোক্তাদের প্রত্যাশার সুযোগ নিতে বিভিন্ন অসৎ পদ্ধতি অবলম্বন করতে দ্বিধা করেন না। নীতি ও মূল্যবোধের সাথে আপস করে পণ্যের ওপর অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারণ এবং ভেজাল পণ্য বিক্রির মাধ্যমে অতিরিক্ত মুনাফার জন্য পাগলপারা থাকেন ব্যবসায়ীরা।

রমজানের এক সপ্তাহ আগেই ইফতার তৈরির সাথে যুক্ত বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয়, মৌলিক উপাদানগুলোর দাম অত্যধিক বাড়িয়ে দেন। এর মধ্যে অন্যতম চিনি, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, রসুন, মসলা, কাঁচামরিচ, শাকসবজি, ছোলা, বেগুন, লেবু ও সবুজ পেঁপে। এসব জিনিসের দাম রোজার শুরুতেই সর্বোচ্চ মাত্রায় বেড়ে যায়।

ঢাকার বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বাজারে গণমাধ্যমের জরিপ থেকে জানা গেছে, গত কয়েকদিনে বেগুন, ছোলা, পেঁয়াজ, শসা, লেবু ও চিনির দাম আকাশছোঁয়া হয়েছে। দেখা গেছে, প্রোটিনের সব প্রয়োজনীয় উৎস যেমন- মাছ, মুরগি, খাসি ও গরুর গোশতের দামও মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে।

খাসির গোশত এখন বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৯৫০ টাকা, গরুর গোশতের দাম ৭০০ টাকার উপরে। ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে প্রায় ১৮০ টাকা কেজি। দেশী মুরগির খুচরা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩৫০ থেকে ৩৮০ টাকা। তেলাপিয়া, পাঙ্গাস ও কই ছাড়া প্রতি কেজি মাছের দাম ৩০০ টাকার ওপরে। রুই ও কাতলা বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে। স্থানীয়ভাবে জন্মানো ফল যেমন- কলা, সবুজ পেয়ারা, খেজুর, ডাব-নারকেল ও কমলা এগুলোর দাম গড়ে ২০ থেকে ৩০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। পিস হিসেবে কেনা তরমুজ ঢাকায় এনে ৪৫-৫০ টাকা কেজি দামে বিক্রি হয়।

এত দাম কেন বাড়ল জানতে চাইলে নিয়মিত উত্তর হলো- পাইকাররা দাম বাড়ালে খুচরা বিক্রেতাদের দোষ দেয়া উচিত নয়। পালাক্রমে, যখন পাইকারি বিক্রেতাদের জিজ্ঞাসা করা হয়, তারা সাধারণত উত্তর দেন, পণ্যটির উৎস থেকে শহরে পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন তারা। টোল বৃদ্ধির কারণে দামও আংশিকভাবে প্রভাবিত হয় বলে অভিযোগ করা হয়, যা নিরাপদ পরিবহনে পথে পথে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দিতে হয়। যে কেউ আশ্চর্য হতে পারেন যে, যোগাযোগ ব্যবস্থায় নজরদারিকারী আইন প্রয়োগকারী বাহিনী এ বিষয়ে আদৌ কোনো নজর দেয় কি না। দিলেও প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট কি না।

এমন বাস্তবতার সাথে আরেকটি দুর্ভাগ্যজনক দিক যুক্ত হয়েছে- ভেজাল, প্রিজারভেটিভ, কাপড়ের রঙ, রাসায়নিক, ফরমালিন ও কার্বাইডের ব্যবহার। নিকট অতীতে ভ্রাম্যমাণ খাদ্য পরিদর্শন দলগুলো এমন কিছু কারখানা চিহ্নিত করেছে; যেখানে অসাধু ব্যবসায়ীরা অস্বাস্থ্যকর ও ভেজাল নিম্নমানের ভার্মিসেলি তৈরি করছেন। এরপর শহরের বাজারের পাশাপাশি গ্রামীণ হাটবাজারেও এ বিপজ্জনক পণ্য দিয়ে সয়লাব করছেন। গ্রামাঞ্চলে ক্রেতা আকর্ষণ করতে এ ধরনের ভার্মিসেলি অপরিষ্কার খোলা জায়গায় শুকিয়ে পরে রঙিন প্যাকেটে প্যাকেটজাত করার খবরও পাওয়া গেছে। আমদানিকারকরা দুধের গুঁড়ো ভেজাল করতে সিন্ডিকেট গঠন করেন। এরপর খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হয়। যারা নিম্নমানের বেকারি, রেস্তোরাঁ ও হোটেলগুলোতে তা পাঠান বলেও রিপোর্ট পাওয়া গেছে।

অসাধু ব্যবসায়ীরাও মৌসুমি ফল ব্যবসার ক্ষেত্রে ভোক্তাদের প্রতি তাদের কুৎসিত ব্যবসায়িক চেহারা দেখালেও কোনো ধরনের লজ্জাবোধ করেন না। জনস্বাস্থ্য এবং ভোক্তা অধিকার সুরক্ষা আইন-২০০৯, খাদ্য নিরাপত্তা আইন-২০১৩, ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৫-এ উল্লিখিত বিধানগুলোর প্রতি কোনো সম্মান ছাড়াই এটি করা হয়। এটি অনেকাংশেই ঘটছে; কারণ দেশের সস্তা খাবারের উৎপাদক ও প্রস্তুতকারকদের প্রতি খুব কমই প্রতিষ্ঠানিক পর্যবেক্ষণ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা এরই মধ্যে পরিস্থিতি আরো কার্যকর নজরদারি করতে প্রচেষ্টা শুরু করেছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে দোষীদের বিরুদ্ধে জরিমানা আরোপ করছে। এটি বোঝা যায়, এ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় ভেজালের সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্য উৎপাদনের তৈরির ক্ষমতা হারাবে।

এ বিষয়ে অনেকেই হয়তো মন্তব্য করবেন, এমন নজরদারি উৎসাহজনক। তবে এর কার্যকারিতা হতাশাজনক। শুধু রমজানজুড়েই নয়, পরবর্তীতেও নিয়মনীতির অধিকতর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে তাদের অতিরিক্ত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হবে। এর জন্য এরই মধ্যে সম্পাদিত পরিদর্শনের সতর্কতামূলক রেকর্ড রাখা এবং ডকুমেন্টেশন প্রয়োজন হবে। এর জন্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন।

যাই হোক, এসব ড্রাইভ চরিত্রগতভাবে স্বেচ্ছাচারী হওয়া উচিত নয় এবং সঠিকভাবে কাজ করে এমন মেকানিজমের সাহায্যে শুধু প্রশিক্ষিত পরিদর্শকদের দিয়ে পরিচালিত হওয়া উচিত। মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষকেও নিশ্চিত করতে হবে, প্রাপ্ত অভিযোগের সত্যতা যাচাইসাপেক্ষে সাজা কার্যকর করার সময়, অভিযুক্তদের আত্মরক্ষার প্রয়োজনীয় সুযোগ দেয়া, যাতে ফৌজদারি বিধির বিভিন্ন ধারায় বর্ণিত অধিকারের লঙ্ঘন না হয়।

খাদ্য নিরাপত্তা সবার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভুলে যাওয়া উচিত নয়, অনিরাপদ খাবার গ্রহণের ফলে গুরুতর রোগ হতে পারে। ক্যান্সার যা লিভার, অন্ত্রের সংক্রমণ এবং তীব্র ডায়রিয়ার সংক্রমণকে প্রভাবিত করতে পারে। আইসিডিডিআরবি প্রকাশ করেছে, ‘খাদ্য ও পানিবাহিত কারণে ডায়রিয়ার চিকিৎসায় প্রতিদিন হাসপাতালে যাওয়ার সংখ্যা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে’। স্পষ্টতই বাংলাদেশে প্রতি বছর এক মিলিয়নেরও বেশি মানুষ খাদ্যবাহিত ও পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হন।

বিদেশে আমাদের খাদ্যসামগ্রীর রফতানি সম্প্রসারণ, বৈচিত্র্য ও বাড়াতে হলে প্রবিধান ও মানদণ্ডের কঠোর বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক। কোভিড মহামারীর বিরাজমান পরবর্তী প্রভাব সত্ত্বেও বাংলাদেশ থেকে মাছ ধীরে ধীরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন বাজারে, রফতানির মর্যাদা পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে, এরই মধ্যে উদাহরণ হয়ে উঠেছে।

এই রমজানে অন্যদের সাহায্য করা আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে। এ প্রসঙ্গে ভোক্তা সুরক্ষা আইন, ২০০৯ এবং এ আইনের অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করার মতো। প্রধান শাস্তিযোগ্য অপরাধগুলো হলো- ক. কোনো আইন বা নিয়ম, কোনো পণ্য, ওষুধ বা পরিষেবা নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি বা বিক্রির জন্য প্রস্তাব করা; খ. জেনেশুনে ভেজাল পণ্য বিক্রি বা বিক্রির প্রস্তাব দেয়া; গ. পণ্য বিক্রির ধারণা নিয়ে মিথ্যা ও অসত্য বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করা; ঘ. কোনো মিথ্যা ওজন বা নিক্তি ব্যবহার করে এবং এর মাধ্যমে গ্রাহককে প্রতারণা করা এবং ঙ. গ্রাহকের কাছে থেকে বিজ্ঞাপন এবং অর্থ প্রদানের চেয়ে কম পণ্য দেয়া। ভোক্তা অধিকারের জন্য কাজ করে এমন যেকোনো ভোক্তা বা সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে এসব চার্জের যেকোনো একটির বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন।

আমাদের মনে রাখতে হবে, ভোক্তাদের অতিরিক্ত খরচের পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্য নিরাপত্তা অবশ্যই মূল্যায়ন করা উচিত। দূষিত খাদ্যের প্রভাব উন্নয়নশীল এবং উন্নত উভয় দেশের মধ্যেই উদ্বেগের সৃষ্টি করে যা খাদ্যজনিত অসুস্থতাকে প্রাদুর্ভাবের দিকে পরিচালিত করে। এ প্রেক্ষাপটে আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, রমজানের নীতি আমাদের ধর্ম নির্বিশেষে সাধারণ সুবিধা ও কল্যাণে একসাথে কাজ করতে শেখায়। অথচ বাস্তব অবস্থা যেন এর ঠিক উল্টো। মনে হয় রমজান যেন আসে ভোক্তাকে শোষণের জন্য। আসুন, আমরা রমজানের আধ্যাত্মিক শিক্ষা গ্রহণ করি। ব্যবসার ক্ষেত্রে মানবিক হই।

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও গবেষক

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877